ভূমি দখলে ধর্মের ব্যবহার

অনেক আগে একটি হিন্দি মুভি দেখেছিলাম। মুভির কাহিনীতে দেখানো হয় যে ঋণের লোভ দেখিয়ে একটি বস্তির লোকজনের কাছ থেকে প্রতারণা করে তাদের বাড়িঘরের দলিলে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। মূলত একজন বিল্ডার সেখানে একটি আধুনিক শপিং সেন্টার বানাতে চায়। বস্তিবাসীরা যখন প্রতিবাদ করতে যায়, তখন বিল্ডার তাদের দেখায় যে তারা দলিলে স্বাক্ষর করেছে, টাকা নিয়েছে এবং জমি বিল্ডারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আইন এখন বিল্ডারের পক্ষে। এখন কী হবে? যেদিন বস্তি ভাঙার কথা, তার আগের রাতে সেই বস্তির জমির নিচে একটি দেবীমূর্তি পাওয়া যায় এবং বস্তির একটি মেয়ের ওপর দেবী ভর করে! তারপর কী হয়? দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন সেই দেবীমূর্তি দেখতে আসে! দেখতে দেখতে জায়গাটি জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে। যে মন্ত্রী বিল্ডারের পক্ষে ছিলেন, তিনিও এসে দেবীমূর্তির পায়ে মাথা ঠেকান! এই উপমহাদেশে ধর্মের নামে এভাবে কত শত জায়গা-জমি দখল হয়ে যায়।

সরকারি খাস জমিতে যদি একবার মসজিদ নির্মাণ করা যায়, তবে সেই মসজিদ আর কোনোভাবেই সরানো সম্ভব হয় না। আপনি আশেপাশে খোঁজখবর নিয়ে দেখুন, এমন পরিচিত ঘটনা দেখতে বা শুনতে পাবেন। ধর্মের নিয়মে কী বলে? সরকারি খাস জমিতে উপাসনালয় তৈরি করা যায়? ওয়াকফ ছাড়া কোনো জমিতে জুমার মসজিদ বানানো যায় না। জমির মালিক যদি নিজে জমি দান না করেন, তবে সেখানে মসজিদ বানিয়ে নামাজ পড়া যায় না। ধর্মের নামে জমি দখলের এই প্রথা এই দেশে খুব ভালোভাবেই চলছে।

আজ ফেসবুকে এমন একটি ঘটনা নিয়ে প্রগতিশীলরা খুব কান্নাকাটি করছে। তবে তাদের কান্নাকাটি ধর্মের নামে জমি দখলের বিরুদ্ধে নয়, বরং দখলকৃত সেই স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে। মঙ্গলবার বাংলা ট্রিবিউনে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদে বলা হয়, খিলক্ষেতে একটি মন্দির ভেঙে ফেলার জন্য একদল মুসল্লি আলটিমেটাম দিয়েছে। এই শিরোনাম যে কতটা ভয়ংকর, তা আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। অথচ আসল কথা হলো, খিলক্ষেতের সেই জায়গায় কোনো স্থায়ী মন্দির নেই। জায়গাটি পুরোপুরি রেলওয়ের সম্পত্তি, অর্থাৎ সরকারি জমি। সেখানে অস্থায়ীভাবে একটি মন্দির তৈরি করা হয়েছে। অস্থায়ী বলতে, সেখানে তাদের ধর্মের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে এবং টিনের চাল ও বেড়া দেওয়া হয়েছে। এই মন্দিরটি প্রতারণার মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে, অর্থাৎ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। গত বছর সেখানে দুর্গাপূজা হয়েছিল, এবং পূজার মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। পূজার পর প্যান্ডেল ভাঙা না হয়ে সেখানে মন্দির স্থাপন করা হয়।

এবার এই অস্থায়ী মন্দিরের জায়গায় স্থায়ীভাবে ইট বসাতে গেলে এলাকার মানুষ এসে বাধা দেয়। এখন আপনারা বলুন, সরকারি জমিতে অবৈধভাবে এই মন্দির স্থাপনে বাধা দেওয়া ঠিক হয়েছে, না ভুল? যদি আপনার মাথায় সামান্য বুদ্ধি থাকে, তবে পরিষ্কার বুঝতে পারবেন যে মন্দির স্থাপনের নামে এই জমি দখলের একটি চক্রান্ত চলছিল। এবং এর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট দলের লোকজন জড়িত।

তবে আজ সেই অস্থায়ী মন্দিরটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে প্রগতিশীলদের মধ্যে খুব কান্নাকাটি চলছে—কেন মন্দির ভাঙা হল? অথচ এটি সরকারি জমি দখল করে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছিল, সে বিষয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে চাই, ২০২১ সালে বরিন্দ্রসরবরের আর রহমান জামে মসজিদটি ভেঙে ফেলা হয়েছিল, কারণ সেটি অবৈধ জমিতে ছিল। তখন কি এরা একটি লাইনও খরচ করেছিল?

আমাদের দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে এত পরিমাণ উপাসনালয় আছে যে নতুন করে আর কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় তৈরির প্রয়োজন নেই। অন্তত সরকারি খাস জমি অবৈধভাবে দখল করে উপাসনালয় তৈরির কোনো প্রয়োজন নেই। কেউ যদি ওয়াকফ করে জমি দান করেন, তবে নতুন করে উপাসনালয় তৈরি করা আলাদা ব্যাপার। কিন্তু সরকারি জমি দখল করে অবৈধভাবে এই কাজ করলে, ধর্ম পালনের চেয়ে সেই জমি থেকে অবৈধ আয়ের উদ্দেশ্যই বেশি থাকে। ধর্মকে ব্যবহার করে এই জমি দখল বন্ধ করতে হবে।