পৃথিবীর অনেক দেশেই কোটার প্রচলন রয়েছে । এই কথা দিয়েই তারা শুরু করে অথচ পুরো সত্যটুকু বলে না। কোটা সিস্টেম হচ্ছে কেবল মাত্র অনাগ্রসর গোষ্ঠীকে প্রতিযোগিতা টিকে থাকার জন্য দেওয়া হয়। এর বাইরে যদি কাউকে কোটা দেওয়া হয় তাহলে সেটা হচ্ছে যোগ্যদের প্রতি অবিচার করা ।
একটা দেশের সকল গোষ্ঠী সমান সুযোগ পায় না । এই যেমন ধরেন ঢাকা শহরের একটা ছেলে বা মেয়ে যতটা সুযোগ সুবিধা পেয়ে বড় হয়, বান্দরবানের মাইকোয়ার পাড়ার একটা ছেলে বা মেয়ে সেই সুযোগ সুবিধা পেয়ে বড় হয় না । বিশেষ করে যে সুযোগ সুবিধাগুলো সরকারের দেওয়ার কথা ছিল সেগুলো ঢাকার ছেলে মেয়েরা পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু মাইকোয়া পাড়ার ছেলে মেয়েরা পাচ্ছে । শুরু থেকেই তারা রয়েছে পিছিয়ে । সেই ক্ষেত্রে এই পিছিয়ে থাকা মানুষদের একটা আলাদা সুযোগ দেওয়া হয় এই কোটার মাধ্যমে । এটাই হচ্ছে যৌক্তিক কারণ। যখন এই দুই এলাকার ছেলে মেয়েরা এক সাথে প্রতিযোগিতায় নামবে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মাইকোয়ারা পাড়ার ছেলে মেয়েরা পিছিয়ে থাকবে। তাদেরকে যে সুযোগ সরকার থেকে দেওয়ার কথা ছিল সেটা না দেওয়ার একটা ক্ষতিপূরণ হচ্ছে এই কোটা ।
আমাদের পাশের দেশ ইন্ডিয়াতে কোটা সিস্টেম চালু রয়েছে। ভারতের মোট কোটা ৫০ ভাগের মত। এর ভেতরে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায় ২৭% কোটা দেওয়া হয়। আমাদের কোটার পক্ষের লোকজন এই উদাহরণ দিতে খুব পছন্দ করে । কিন্তু এর পেছনে যে আরও কত গুলো সত্য লুকিয়ে রয়েছে সেটা খুব যত্ন করেই এড়িয়ে যায়।
ভারতের এই ২৭% কোটার যে গোষ্ঠীকে দেওয়া হয় সেই গোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার কত পার্সেন্ট জানেন? ৪২%।
জ্বী । ৪২% গোষ্টীর জন্য ২৭% কোটা । কিন্তু এখানেই শেষ নয় । এই ৪২% পিছিয়ে পড়া নিম্নগোত্রের যে তালিকা রয়েছে সেটা দুই তিন বছর পরপরই আপডেট করা হয় । এবং সব থেকে জরুরী ব্যাপার হচ্ছে এই কোটা এক পরিবারের কেবল একবারই ব্যবহার করতে পারবে। এমন কি উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এই কোটা ব্যবহার করে তাহলে পরবর্তীতে চাকরি ক্ষেত্রে আর এই কোটা ব্যবহার করতে পারবে না। কোটাভুক্ত পরিবারের কেউ যদি একবার কোটা ব্যবহার করে পরবর্তিতে আর কেউ সেই কোটা ব্যবহার করতে পারবে না । এছাড়া কোণ পরিবারের কেউ যদি বড় কোন চাকরি করে, ডাক্টার ইঞ্জিনিয়ার টাইপের কিছু হয় তাহলেও সেই পরিবারের কেউ আর কোটা ব্যবহার করতে পারবে না।
আমাদের দেশে যে কোটা সিস্টেম চালু রয়েছে সেটা কোন দিক দিয়ে আপনার কাছে যৌক্তিক মনে হয়? কোটা সিস্টেম বাতিলের কথা কেউ কখনো বলে নি । সেই ২০১৮ সালে যখন প্রথম আন্দোলন শুরু হয় তখন সবার দাবী ছিল যে কোটা সিস্টে সংস্কার করতে হবে। কোন ভাবেই ৫৬% কোটা রাখা যাবে না । সেই সময় সরকারী দলের পান্ডা আর পুলিশ মিলে সাধারণ ছাত্রদের উপরে ন্যক্কারজনক হামলা করেও তাদের দমন করতে পারে নি।
এই যে ৫% উপজাতি কোটা রয়েছে মোট উপজাতি কি মোট জনসংখ্যার ৫%? বাংলাদেশের মোট উপজাতি জনসংখ্যার ১% এর কম। এক শতাংশের কমের জন্য ৫% অন্যায় এবং অযৌক্তিক।
জেলাকোটা কেন থাকবে? এই আমাদের সরকার গত পনের বছর ধরে উন্নয়নের এতো গুণগান করে যাচ্ছে তাহলে আবার জেলাকোটা কেন? এই উন্নয়নের রোল মডেল, ডিজিটার বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশের এই গান আমাদের শোনানো হচ্ছে তাহলে জেলা কোটা কেন থাকতে হবে? যদি জেলা কোটা রাখতেই হয় তাহলে আগে সরকারকে নাকে খর দিয়ে এটা স্বীকার করতে হবে যে তারা বাংলাদেশের সব জায়গায় সমান উন্নয়ন সমান সুযোগ সুবিধা দিতে পারেন নি। এই জন্য জেলা কোটা দরকার । এটা আগে তারা স্বীকার করুক !
তারপর আসুক নারী কোটা । যে মেয়েটা বুয়েট থেকে পাশ করল যে মেয়েটা ঢাবির পদার্থ বিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স শেষ করল সে কি কোন অংশ কম ? তাহলে একই বিভাগ থেকে আরেকটা ছেলে যখন তার সাথে প্রতিযোগিতায় নামবে, এই মেয়ে আগে থেকে সেই ছেলের থেকে ১০ কদম এগিয়ে থাকবে এই কোটার কারনে ! এটা কি সেই ছেলের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে না? আজ থেকে ২০/২৫ বছর আগে যদি নারী কোটা থাকতো সেই সময়েও মেনে নেওয়া যেত। সেই সময়ে নারীরা অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এখন কি সেই অবস্থা রয়েছে? যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস রুমের দিকে তাকান ? যে কোন চাকরির পরীক্ষার দিকে তাকান । কোন দিক দিয়ে নারীরা এখন পিছিয়ে রয়েছে? বরং এসএসসি এইচএসসি রেজাল্টে ছেলেদের থেকে মেয়েরা ভাল ফল করছে। তারা ভাল জায়গায় পড়াশোনা করছে ।
দেশে মোট মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কত?
সবার আগে একটা কথা বলা দরকার। বর্তমানে চাকরিতে যা রয়েছে সেটা মুক্তিযোদ্ধা কোটা না, সেটা মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটা । এই দুইটার ভেতরে পার্থক্য রয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা আর তার ছেলে বা তার নাতি এক না। পৃথিবীর অনেক স্থানেই বীরদের সম্মানিত করার রীতি রয়েছে। কিন্তু বীরদের নাতিদেরো সম্মানিত করার রীতি কোথায় রয়েছে? মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার অনেক কিছুই করছেন, এতে দেশের জনগনের আপত্তি নেই এবং সামনে যদি আরো কিছু করা হয় তাতেও দেশের জনগন কোন আপত্তি করবে না। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে নাতিপুতিরা দেশের জন্য আলাদা ভাবে কিছু করে নি। তাদেরকে আলাদা সুবিধা দেওয়া মানে দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করা। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের পর্যন্ত কোটা রাখা হোক। তবে নাতিপুতিদের পর্যন্ত কোটা রাখা অন্যায় এবং অযৌক্তিক !
সব চেয়ে যৌক্তিক কোটা হচ্ছে প্রতিবন্ধি কোটা । এটা এমন একটা ব্যাপার যেখানে বরং কোটা না দিলেই তাদের প্রতি অবিচার করা হবে।
কোটা বাতিল নয়, কোটা সংস্কার প্রয়োজন । সব মিলিয়ে মোট কোটার পরিমান ৫-৭% এর বেশি হওয়া যাবে না।
কোটা রাখা বা না রাখা এটা সম্পূর্ন ভাবে সরকারের নিজের ইচ্ছা । এখানে হাইকোর্টের কিছু বলার নেই। সরকার যদি কোটার পরিমান ৮০% করে সেখানেও যেমন হাইকোর্টের কিছু করার নেই ঠিক তেমনি ভাবে যদি ৫% করে সেখানেও কিছু বলার নেই । আওমীলীগ সরকার হাইকোর্টের উপরে দিয়ে পার পাওয়ার পরিকল্পনা করছে। এছাড়া আর কিছুটা । সরকার আজকে গিয়ে সংসদে পরিপত্র জারি করলেই কাজ হয়ে যাবে । সেখানে কারো কিছু বলার থাকবে না। এই জন্যই আন্দোলন চলছে।