সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর নতুন ট্যারিফ আরোপ করেছে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ট্যারিফের হার বেড়ে ৩৭% হয়েছে, যেখানে আগে এটি ছিল ১৫%। এই লেখায় আমরা ট্যারিফের এই পরিবর্তনের তাৎপর্য এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব। ট্যারিফ হলো আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপিত একটি কর বা ট্যাক্স। সাধারণত এই ট্যাক্সের বোঝা শেষ পর্যন্ত গ্রাহকদের কাঁধেই পড়ে। অর্থাৎ, বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বাড়তি ট্যারিফের ফলে আমেরিকার জনগণকেই বেশি দাম দিতে হবে।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, যদি এই ট্যারিফ আমেরিকানদের পকেট থেকেই যায়, তবে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭% ট্যারিফ আরোপের উদ্দেশ্য কী? এটি বোঝার জন্য একটি সহজ উদাহরণ দিই।
ধরা যাক, বাংলাদেশে ১০ ডলার মূল্যের একটি শার্ট তৈরি হয় এবং তা আমেরিকায় রপ্তানি করা হয়। আগে ১৫% ট্যারিফের সময় এই শার্টের ওপর ১.৫ ডলার ট্যাক্স যোগ হতো, ফলে আমেরিকার বাজারে এর দাম হতো ১১.৫ ডলার। এখন ৩৭% ট্যারিফের ফলে ৩.৭ ডলার যোগ হবে, এবং শার্টটির দাম দাঁড়াবে ১৩.৭ ডলার। এই বাড়তি টাকা বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের পকেট থেকে যায় না, বরং আমেরিকার গ্রাহকরা তা পরিশোধ করেন। তাহলে এর মাধ্যমে কী লাভ হয়?
একটি দেশ অন্য দেশের পণ্যের ওপর ট্যারিফ আরোপ করে মূলত তিনটি কারণে: দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা, সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা।
১. দেশীয় শিল্পের সুরক্ষাঃ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিদেশি পণ্যের দাম যদি দেশীয় পণ্যের দামের কাছাকাছি থাকে, তাহলে গ্রাহকরা সাধারণত বিদেশি পণ্য পছন্দ করেন। এতে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্যারিফের মাধ্যমে বিদেশি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে দেশীয় পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ১০০ ডলারের একটি বিদেশি ফোনের ওপর ৩৭% ট্যারিফ আরোপ করলে এর দাম হয় ১৩৭ ডলার। ট্যারিফ না থাকলে এই ফোনের দাম থাকত ১০০ ডলার, এবং তখন দেশীয় ফোনের বাজার ধরে রাখা কঠিন হতো।
২. সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধিঃ ট্যারিফ থেকে আসা অতিরিক্ত অর্থ সরকারের আয় বাড়ায়। আগে বাংলাদেশি প্রতি ১০ ডলারের পণ্যে আমেরিকার সরকার ১.৫ ডলার পেত। এখন ৩৭% হারে তারা পাবে ৩.৭ ডলার। এটি সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির একটি কার্যকর উপায়।
৩. বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষাঃ দুই দেশের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানির ভারসাম্য বজায় রাখা বাণিজ্য ভারসাম্য। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬.২ বিলিয়ন ডলার। যখন আমদানি বেশি হয়, তখন ট্যারিফ বাড়িয়ে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়, যাতে আমদানি কমে। আবার আমদানি কমে গেলে ট্যারিফ কমিয়ে চাহিদা বাড়ানো হয়। এভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়।
বাংলাদেশের ওপর প্রভাব
এই ২২ শতাংশ পয়েন্ট (১৫% থেকে ৩৭%) ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে আমাদের পণ্যের দাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়বে। ১১.৫ ডলারের একটি শার্ট এখন বিক্রি হবে ১৩.৭ ডলারে। এটি আমাদের রপ্তানি খাতে, বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে, প্রভাব ফেলবে। আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের শক্তি কী? আমাদের কি উন্নত প্রযুক্তি বা অসাধারণ কাজের মান আছে? না, আমাদের প্রধান শক্তি হলো সস্তা শ্রম।
যুক্তরাষ্ট্রে একজন গার্মেন্টস শ্রমিক ঘণ্টায় ১৫-১৬ ডলার আয় করেন, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১,৬৫০ টাকা (১ ডলার = ১১০ টাকা ধরে)। অন্যদিকে, বাংলাদেশে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের মাসিক বেতন ১২,৫০০ টাকা, যা ২৪০ কার্যঘণ্টা ধরলে ঘণ্টায় ৫২ টাকা বা ০.৪৭ ডলার। এটি আমেরিকার তুলনায় প্রায় ৩২ গুণ কম। এই সস্তা শ্রমের কারণেই বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ থেকে পোশাক তৈরি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ নীতির লক্ষ্য দেশীয় শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা। তারা চায় আমেরিকানরা যে পোশাক পরে, তা আমেরিকাতেই তৈরি হোক। কিন্তু আমেরিকায় শ্রম খরচ অনেক বেশি। বাংলাদেশে ১০ ডলারের একটি শার্ট তৈরি করে ১৩.৭ ডলারে বিক্রি হয়। আমেরিকায় একই শার্ট তৈরি করতে শ্রম খরচই ২০ ডলারের বেশি হতে পারে। যদি আমেরিকায় উৎপাদিত শার্টের দাম ১৩.৭ ডলারের কম বা কাছাকাছি হয়, তবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের জন্য তা বড় ধাক্কা হবে। তবে দাম অনেক বেশি হলে আমাদের ক্ষতি সীমিত থাকতে পারে।
এছাড়া, অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা আরেকটি চ্যালেঞ্জ। ভারতের ওপর ট্যারিফ ২৬%, আমাদের থেকে ১১% কম। ভারতে শ্রমিকদের ঘণ্টায় মজুরি ০.৮৬ ডলার, আমাদের ০.৪৭ ডলারের তুলনায় সামান্য বেশি। ১০ ডলারের একটি ভারতীয় শার্ট আমেরিকায় বিক্রি হবে ১২.৬ ডলারে, আমাদের ১৩.৭ ডলারের তুলনায় ১.১ ডলার কম। এই দামের পার্থক্য আমাদের গার্মেন্টস অর্ডার অন্য দেশে, যেমন ভারতে, সরে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে।
এই ট্যারিফ বৃদ্ধি বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর প্রভাব কতটা গভীর হবে, তা নির্ভর করবে বাজারের প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের মোকাবিলার কৌশলের ওপর। সস্তা শ্রমের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে এবং বিকল্প বাজার খুঁজে আমাদের এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে।
---
Comments
Post a Comment