মেয়েদের শিক্ষা ও চাকরিই দায়ী


 আমাদের দেশে ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে কারণ হিসাবে এখন মেয়েদের পড়াশোনা আর চাকরিকে অনেকেই দায়ী করে থাকে। বিশেষ করে আমাদের সবার প্রিয় এবং পছন্দের হুজুর শ্রেণীর একটা পছন্দের অভিযোগই হচ্ছে এখনকার দিনে বিয়ে টিকছে না, কারণ মেয়েরা পড়ালেখা করছে, বাইরে কাজ করছে !

সত্যি বলতে কি তাদের অভিযোগ কিন্তু একেবারে মিথ্যে না । ব্যাপারটা সত্যিই কিন্তু এমন ঘটছে। তবে তারা কারণটা যেভাবে ব্যাখ্যা করে সেটা অন্য রকম ।

আগে ডিভোর্সের সংখ্যা কম ছিল কেন আর এখন বেশি কেন?

খুব সহজ ভাবেই ব্যাপারটা ভাবুন । জীবন ধারণ বা বেঁচে থাকার জন্য মানুষের সব থেকে বেশি দরকার হচ্ছে টাকা । চাকরি বা ব্যবসা করে সেই টাকা আয় করা যায় । আজ থেকে মাত্র ৫০ বছর আগেই যদি আপনি দেখেন তাহলে দেখবেন এই জীবিকা নির্বাহ করে টাকা আয়ের পথে অনেকটাই কেবল মাত্র পুরুষদের দখলে ছিল। মেয়েরা বেশি পড়াশোনা করত না বা করতে পারত না । এসএসসি ইন্টার পাশ করার পরপরই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত । তখন পরিবার গুলোর ভেতরে মেয়েদের জলদি জলদি বিয়ে দিয়ে দেওয়ার একটা চল ছিল। এখনও সেই চল আছে তবে আগের মত এতোটা তীব্র নয়।

এরফলে কী হত? মেয়েরা কম শিক্ষিত। আর শিক্ষার মান কম মানেই হচ্ছে তাদের ভেতরে কম সচেতনাবোধ, নিজের অধিকার সম্পর্কে কম জ্ঞান থাকা এবং সব থেকে বড় ব্যাপার হচ্ছে এই কম শিক্ষার ফলে নিজের স্বাবলম্বী হতে না পারা ! বেঁচে থাকার জন্য অন্যের উপর নির্ভর করা । বিয়ের পরে বেঁচে থাকার জন্য নিজের স্বামীর উপর নির্ভর করা । মানে হচ্ছে যদি তখন মেয়েটি নিজের স্বামীকে ছেড়ে চলে যায় তাহলে তার মাথার উপর থেকে ছাদ সরে যাবে। নিজের স্বামীর সাথে থাকার এর থেকে আর বড় মোটিভেশন আর কী আছে? তখন মেয়েদের যাওয়ার জায়গা ছিল না । স্বামী যেমনই হোক তার সাথে তাদের থাকতেই হত। চড় থাপ্পড় মাইর খেয়েও থাকত হত। কারণ তাদের আর কোন যাওয়ার জায়গা ছিল না। এখন একটা তথ্য দিয়ে রাখি যে ডামিস্টিক ভায়োলেন্সে বাংলাদেশ পৃথিবীর চতুর্থ। বাবার বাড়িতে যাওয়া যেত কিন্তু যেই সময়ের সমাজের মনভাবটাই এমন ছিল যে বাবার বাড়িতেও মেয়ের সাথে আর আগের মত আচরণ করা হত না । আর তখন ছেলে মেয়েদের সংখ্যা থাকত বেশি তাই এই ব্যাপারটা গা ছাড়া ভাব দেখাত । 

কিন্তু এখন মেয়েদের যাওয়ার জায়গা রয়েছে । মাথার উপরে ছাদ রয়েছে । অর্থ্যাৎ স্বামী যদি চলেও যায় তারপরেও তাদের যাওয়ার জায়গা রয়েছে । এবং এই ছাদ তারা নিজেরা তৈরি করেছে । এখন এটা কি স্বাভাবিক না যে যখন তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা হবে বা তাদের গায়ে হাত তোলা হবে তখন তারা স্বামী ঘর না করে চলে আসবে?

এছাড়া আরেকটা কারণ হচ্ছে আগে মেয়ের বাবার পরিবার মেয়েদের এই ডিভোর্সের ব্যাপারটাকে সমর্থন করত না । কারণ তখন সমাজের চিত্রই এমন ছিল এবং এবং তাদের ছেলে মেয়েদের সংখ্যাও থাকত বেশি । কিন্তু এখন সমাজের চিত্র একটু বদলেছে, যদিও খুব বেশি না তবে একটু বদল এসেছে ঠিকই এবং এখন বাবা মায়ের সন্তান থাকে কম । বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এক মাত্র মেয়ে । এখন মেয়ে যখন অশান্তিতে থাকে, খারাপ থাকে, স্বামীর হাতে মাইর খায় কিংবা স্বামীর সাথে বনিবনা হয় না তখন, তখন তাদের মেয়ে যে সুখে নেই এটা তাদের কাছে মূখ্য একটা ব্যাপার হয়ে ওঠে যা আগে হত না । আগে বাবা মায়েদের বক্তব্য ছিলই যে মানিয়ে নাও, এই রকম হয়েই থাকে । কিন্তু এখন ব্যাপারগুলো আর আগের মত নেই।

আগে মেয়েদের মাথায় এই ব্যাপারটাই ঢুকিয়ে দেওয়া হত যে তোমাকে তোমার স্বামীর সংসারই করতে হবে, তার ইচ্ছেই তোমার ইচ্ছে, তোমার নিজের কোন ইচ্ছে নেই। সে যা বলবে তোমাকে তাই করতে হবে। মেয়েরাও এটাই মেনে নিত । মেনে নিতে বাধ্য হত । কারণ তাদের কাছে না ছিল শিক্ষা আর না ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। কিন্তু যখন মেয়েরা আস্তে আস্তে শিক্ষা লাভ করতে শুরু করল তাদের কাছে এটা পরিস্কার হতে শুরু করল যে না স্বামী যা বলবে সেটাই তাদের ইচ্ছে না, স্বামী আর যাই হোক তার গায়ে হাত তোলার অধিকার রাখে না, নিজের ইচ্ছে তার উপর চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার স্বামীর নেই তখন থেকেই এসবের শুরু ! সব থেকে বড় কথা পড়ালেখার শেখার কারণে মেয়েদের ভেতরে একটা আত্মসম্মানবোধ জন্ম নিয়েছে। মেয়েরা এখন এই ব্যাপারটাকে খুব বেশি গুরুত্বদেয় ! স্বামীর কাছ থেকে আদর ভালবাসার থেকেও সম্মানটা বেশি দাবী করে । আগের জামার মেয়েদের ভেতরে এই ব্যাপারটা ছিলই না বলতে গেলে ! 

আমাদের মাঝে অনেকের অবশ্য এটাকে সঠিক বলে মনে করেন । তাদের কাছে মনে হয় যে মেয়েরা স্বামীর কথায় উঠবে বসবে এটাই সঠিক পদ্ধতি । এটাতে অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে খুব একটা লাভ নেই । তারা ছোট থেকে যা দেখেছে তাই শিখে এসেছে । তারা দেখে তাদের বাবা চাচারা তাদের মা চাচীদের সাথে ঠিক এমন আচরণ করে এসেছে । তারা দেখেছে তার বাবা কথায় কথায় মায়ের গায়ে হাত তুলেছে, নিজের কথা চাপিয়ে দিয়েছে মায়েরাও চুপচাপ মেনে নিয়েছে তা । এখন যখন সেও একই কাজ তার স্ত্রীর সাথে করতে গেছে তখন স্ত্রী মানে নি, প্রতিবাদ করেছে, স্ত্রীকে এক চড় দিলে সেও দিয়ে আরেকটা। এতে তাদের মনে হয়েছে আমার মা-চাচীরা তো এমন করে নাই। এই মেয়ে কেন করছে? তার মানে এই মেয়ে খারাপ ! কিন্তু এই বুরবাকদের মাথায় এটা আসে না যে তার মা চাচীরা ছিল মূর্খ অর্থনৈতিক ভাবে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল কিন্তু তার বউ তেমন নয় । দুইজনের আচরণ তাই এক রকম হবে না । 

একটা দৃশ্যের কয়েকটা ভার্শন কল্পনা করুন !

ধরুন আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছে । দৃশ্য একে আপনার মেয়ে জামাই খুবই ভাল । আপনার মেয়েকে সম্মান করে তার সাধ্যমত চেষ্টা করে আপনার দেখা শুনা করার ! এই দৃশ্যের দুইটা সাবভার্শনের একটা হচ্ছে আপনার মেয়ে শিক্ষিত এবং চাকরি করে। অন্যটাতে আপনার মেয়ে খুব বেশি শিক্ষিত না এবং চাকরিও করে না । পুরোপুরি হাউজ ওয়াইফ ! 

আপনার কী মনে হয় এই দুই দৃশ্যের একটাও আপনার মেয়ের ডিভোর্স হতে পারে? বলছি না যে পারে না । তবে সেই সম্ভবনা কম ! অনেক কম। 

এবার দ্বিতীয় দৃশ্যে কল্পনা করুন আপনার মেয়ে জামাই জুতের না । যে অন্য মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট, আপনার মেয়েকে ধরে মারে, মদ গাজা খায় ইত্যাদি । এই দৃশ্যের দুইটা সাবভার্শন আছে। আপনার মেয়ে শিক্ষিত, চাকরি করে। অন্যটাতে সে চাকরি করে না । এখন কোনটাতে ডিভোর্সের সম্ভবনা বেশি। দুইটাতে রয়েছে সম্ভবনা তবে শিক্ষিত চাকরি ক্ষেত্রে এটা প্রায় শতভাগ সম্ভবনা !

না, আমি সব দোষ ছেলেদের দিচ্ছি না । একটা ডিভোর্সের পেছনে যেমন ছেলেদের দোষ রয়েছে ঠিক তেমন ভাবে ।

মেয়েদের দোষও আছে । তবে আমাদের দেশের একটা শ্রেণী কেবল মাত্র মেয়েদেরকেই দোষারোপ করে থাকে । আমার খুব পরিচিত একজনের ডিভোর্স হয়েছে । ডিভোর্সের কারণটা ছিল স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়া তবে সেটা চুড়ান্ত পর্যায়ে যায় তখন স্বামী তার গায়ে হাত তোলে । যখন মানুষজন এটা জানল যে স্বামীর গায়ের হাত তোলার কারণে ডিভোর্স হয়েছে তারা অবাক হয়ে গেল। এবং এদের ভেতরে মেয়েরাও ছিল। স্বামী গায়ে হাত তুলে যেন কোন অন্যায় করে নি বরং সে ডিভোর্স নিয়েই অন্যায় করেছে। 

Comments