বড় আফসোস

টুইন ক্যারোল

মানুষের জীবনে অনেক রকমের আফসোস থাকে । বেশির ভাগ মানুষই জীবনে যা আয় তার বেশির ভাগ জিনিসই পায় না । আমিও সেই দলেই । তবে আমি এই না পাওয়ার সাথে খুব ভাল করেই ডিল করে নিয়েছি । এই বয়সে আমি যখন পেছনে ফিরে তাকাই তখন একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখি যে আমি আসলে এক সময়ে যা চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম যে এই জিনিস গুলো ছাড়া আমার চলবে না, এখন সেই সব জিনিস মোটেই আমার কাছে গুরুত্ব বহন করছে না । কিন্তু একটা না পাওয়া আমি কোন দিন কাটিয়ে উঠতে পারি নি । তা হচ্ছে ঢাবিতে না পড়তে পারাটা । ভাবছেন যে চান্স পাই নি, তাই পড়তে পারি নি? সেটা হলে তো মনে কোন দুঃখই থাকতো না । আমি সব সময় বিশ্বাস করে যার যা যোগ্যতা আছে তার তাই পাওয়া উচিৎ । যার যোগ্যতা নেই সে পাবে না । এমন অনেক কিছুই হয়েছে যা আমি পারি নি সেটা

নিয়ে আমার মনে কোন দুঃখ নেই । কিন্তু ঢাবিতে আমি চান্স পেয়েও পড়তে পারি নি কেবল নিজের পরিবারের কারণে । এই দুঃখ আমার কোণ দিন যায় নি, হয়তো কোন দিন যাবেও না ।  


আমার ছোট থেকেই আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার একটা ইচ্ছে ছিল । সব সময় কল্পনা করতাম যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হব । অন্য কোথাও পড়ার ইচ্ছে ছিল না কোন দিন । প্রথমবার আমি ঢাবিতে পরীক্ষা দিতে পারি নি, কারণ সেইবার আমার ঠিক পরীক্ষার আগের দিন চিকেনপক্স হয়েছিল । পরেরবার আরও ভাল করে পড়াশুনা শুরু করলাম । এইবার পেতেই হবে চান্স । তবে কপাল খারাপ ছিল একটু । পরীক্ষা খুব বেশি ভাল হল না । সিরিয়াল আসলো একটু দূরে । তনে অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমার চান্স হয়ে গেছে । জবিতে আমার সিরিয়াল ছিল ১০৫তম । রাবিতে অন্তত ৮/৯টা বিষয়ে চান্স হয়েছিল । তখন সেখানে আলাদা আলাদা ভাবে পরীক্ষা হত । এখনকার মত ইউনিট ভিত্তিক হত না । সমাজ কর্মে আমার সিরিয়াল ছিল ২০তম । ইবিতে এসেছিল ২৩৩তম । এই সিরিয়াল গুলো মনে আছে । 

আমার মনে হচ্ছিল যে ঢাবিতে আমাকে ডাকবে । একতু দেরিতে হলেও । ডেকেছিলও । থার্ড কলে আমার সিরিয়াল আসে । তবে ততদিনে আমি জবিতে ভর্তি হয়ে গেছি । থার্ড কলে যখন ডাকলো তখন আমি মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি যাবো সেখানে পড়তে । সাব্জেক্ট যাই হোক না কেন । বাসায় যখন বললাম তখন আমাকে বলল, এতো গুলো টাকা দিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছ এখানেই পড় । বিশ্বাবিদ্যালয় কোন ব্যাপার না পড়াই আসল !

জবিতে ভর্তি হতে তখন আমার ১৫ হাজার টাকা লেগেছিল । সেই সময়ে এই ১৫ হাজার টাকা অনেক টাকা । ঢাবিতে ভর্তি হতে সম্ভবত লাগতো ৩৩০০ টাকা । মাত্র ৩৩০০ টাকা !

মাত্র ৩৩০০ টাকার জন্য আমার এই পুরো জীবনের স্বপ্ন নষ্ট হল । এমন না যে টাকা আমার বাপের ছিল না, টাকা ছিল  । তার ব্যবসা মোটামুটি ভাল চলে । মাত্র ৩৩০০ টাকা । আমার পরিবার কোণ দিন উপলব্ধিও করতে পারে নাই যে আমি সেদিন কী পরিমান কষ্ট পেয়েছিলাম । তারা এখনও হয়তো বুঝেই নাই । জানেও না !

আমি জীবনে আমার বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবাসতে পারি নি । সত্যিই পারি নি । আমি কোন যেখানে পড়তেই চাই নি, সেটাকে কিভাবে ভালবাসবো ? কেবল পড়তে হয় বলে পড়েছি । কয়েকজন বুন্ধ জুটেছিল ভাল । এখনও আছে তারা । বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার ঋণ এই যে তার কারণে এই বন্ধু আমি পেয়েছিলাম । 

এরপর ঢাবির আইইআর অনুষদে আমার সিরিয়াল ছিল ৬৯ । সেখানেও ভর্তি হতে পারি নি এই একই কারণে । এই টাকা ! মাত্র কয়েক হাজার টাকা । আমার ফ্যামিলির কাছে তখন টাকাই ছিল প্রধান । ১৫ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছি এই টাকা নষ্ট করা যাবে না । আমার সারা জীবনের সেই স্বপ্ন মাত্র ১৫ হাজার আর সাড়ে তিন হাজার টাকার কাছে অতিতুচ্ছ ! মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে মেয়েদের স্বপ্ন গুলো সব সময় এই টাকার কাছে পরাজিত হয় ! পরবর্তীতে আমি কত টাকা আয় করেছি । এখনও করছি কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন আর আমাকে ধরা দেয় নি ।

আমি নিজের মন কে বুঝিয়ে নিতাম যদি আবার বাবার কাছে টাকা না থাকতো । কিন্তু তার কাছে ছিল । মাত্র তিন হাজার টাকা তার কাছে কোণ ব্যাপার ছিল না । সত্যিই ছিল না । কেবল সামান্য একটু ইচ্ছে ছিল আমার মনকে বোঝার ! তারপর থেকে আমি কোন দিন তার কাছে আর কিছু চাই নি । অবশ্য আমি কখনই কোণ দিন অন্যায় আবদার করি নি । 

আমি পারতপক্ষে সব সময় ঢাবি এলাকা এড়িয়ে চলি । কারণ এখনও কোণ কারণে এই এলাকাদিয়ে যাওয়া আশা করতে গেলে আমার সেঈ পুরানো কষ্ট টা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ! বই মেলার সময় কেবল ওখানে যাই । নয়তো বাধ্য না হলে ঢাবির ভেতরে ঢুকি না ।  এই কাল কনভোকেশন হবে ঢাবির । এই ছবি গুলো দেখলে আমার কষ্ট লাগবে ! এই আফসোস থেকে আমার কোণ মুক্তি নেই জানি । এবং এটার পেছনের কারণ টা আমি নই ।


Comments